জমজম ইসলামী হাসপাতাল, রাজশাহী

Malaria

বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস

প্রতিবছর এপ্রিল মাসের ২৫ তারিখে সমগ্র বিশ্বে পালন করা হয় বিশ্ব ম্যালেরিয়া দিবস। ২০০৭ সালে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রথম এ দিবস প্রবর্তন করে। এর উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণের মধ্যে ম্যালেরিয়া সম্পর্কে সচেতনতা তৈরী এবং প্রতিরোধে কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণে তাঁদের উদ্বুদ্ধ করা।

ম্যালেরিয়া হচ্ছে মশাবাহিত প্লাজমোডিয়াম পরজীবী দ্বারা সৃষ্ট রোগ। মূলতঃ স্ত্রী জাতীয় অ্যানোফিলিস নামক এক ধরণের মশার কামড়ের মাধ্যমে এ রোগ হয়ে থাকে। এ পর্যন্ত ৬০ এর অধিক প্রজাতির ম্যালেরিয়া পরজীবী আবিষ্কার করা হয়েছে এবং এদের মধ্যে ৪টি প্রজাতি মানুষের শরীরে ম্যালেরিয়া রোগ সৃষ্টির জন্য দায়ী।

প্লাজমোডিয়াম ভাইভাক্স, ফ্যালসিপ্যারাম, ম্যালেরি ও ওভাল-এর যেকোনো একটি জীবাণু বহনকারী মশার কামড়ে ম্যালেরিয়া হতে পারে। এর মধ্যে ফ্যালসিপ্যারাম ম্যালেরিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক যা মস্তিষ্কে প্রভাব ফেলে। সংক্রমিত মশা যখন কোনো ব্যক্তিকে কামড়ায়; তখন ওই ব্যক্তির রক্তে ম্যালেরিয়ার জীবাণু প্রবেশ করে এবং ব্যক্তিটি ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত হয়। এ ছাড়াও ম্যালেরিয়ায় আক্রান্ত কেউ যদি অন্য কোনো সুস্থ ব্যক্তিকে রক্ত দান করে, তাহলে সে ব্যক্তির দেহেও এই জীবাণু প্রবেশ করতে পারে।

রোগের লক্ষণের ধরণ অনুসারে ম্যালেরিয়া রোগকে দুই ভাগে ভাগ করা হয় -

১. সাধারণ ম্যালেরিয়া

    • নির্দিষ্ট সময় পরপর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা এ রোগের প্রধান লক্ষণ। নিয়মিত ও নির্দিষ্ট বিরতিতে জ্বর আসা-যাওয়া করে; যেমন- একদিন পর পর জ্বর আসে এবং ৩-৪ ঘন্টা স্থায়ী হয় এরপর ঘাম দিয়ে জ্বর ছেড়ে যায়।
    • মাঝারি থেকে তীব্র কাঁপুনি বা শীত শীত অনুভূত হয়, অনিদ্রা দেখা দেয়।
    • শরীরের তাপমাত্রা কমে যাওয়ার ফলে অত্যধিক ঘাম হয়। বেশী বেশী পিপাসা লাগে।
    • মাথাব্যথা, গায়ে প্রচণ্ড ব্যথা ও তলপেটে ব্যথা অনুভূত হয়।
    • খিঁচুনি হতে পারে।
    • ক্লান্তি বা অবসাদ অনুভব করা।
    • হজমের গোলযোগ দেখা দেওয়া। বমি বমি ভাব অথবা বমি হওয়া।
    • ডায়রিয়াও হতে পারে।

২. মারাত্মক ম্যালেরিয়া

ম্যালেরিয়া রোগের জটিল ধরণ হলো মারাত্মক ম্যালেরিয়া। জরুরী চিকিৎসা না পেলে এসব রোগীর মৃত্যু হতে পারে৷ মারাত্মক ম্যালেরিয়া রোগে সাধারণতঃ নিম্নলিখিত লক্ষণ ও উপসর্গসমূহ দেখা যায় –

    • পানিশূন্যতা। 
    • লোহিত রক্তকণিকা ধ্বংস হওয়ার কারণে অ্যানিমিয়া বা রক্তশূন্যতা।
    • মাংসপেশি, প্লীহা ও যকৃত বড় হয়ে যাওয়া বা যকৃত বা লিভারের অকার্যকারিতা দেখা দেওয়া।
    • শ্বাসকষ্ট হওয়া।
    • কিডনির অকার্যকারিতা।
    • খিঁচুনি।
    • জন্ডিস।
    • রক্তে গ্লুকোজ কমে যেতে পারে। এক্ষেত্রে রোগীর বারবার বমি হয়। নিজে বসতে, দাঁড়াতে বা হাঁটতে অসুবিধা হয় এবং কখনও কখনও রোগী অজ্ঞানও হয়ে যেতে পারে।

সংক্রমণের ধাপ/পর্যায়

    • প্রথম দিকে মাথাধরা, ক্ষুধামন্দা, বমি বমি ভাব, কোষ্ঠকাঠিন্য, অনিদ্রা ইত্যাদি লক্ষণ দেখা দেয়।
    • দ্বিতীয় পর্যায়ে রোগীর শীত শীত অনুভূত হয় এবং কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসে। জ্বর ১০৫°-১০৬° ফারেনহাইট পর্যন্ত হতে পারে। কয়েক ঘণ্টা পর জ্বর কমে যায়। পরে আবার আসে। ৪৮ ঘণ্টা পর পর কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা Plasmodium vivax দ্বারা সৃষ্ট ম্যালেরিয়ার প্রধান লক্ষণ।
    • তৃতীয় পর্যায়ে রোগীর দেহে জীবাণুর সংখ্যা অসম্ভব ভাবে বেড়ে গেলে রক্তের লোহিত কণিকা ভাঙতে থাকে, ফলে রক্তশূন্যতা দেখা দেয়। যকৃত বড় হয় ও সংক্রমিত হয়। প্লীহা, মস্তিষ্ক আক্রান্ত হয়ে রোগীর মৃত্যুও ঘটতে পারে।

বিঃ দ্রঃ মশার কামড়ের ১০ থেকে ১৫ দিনের মধ্যে সাধারণতঃ আক্রান্ত ব্যক্তির দেহে রোগের উপসর্গ দেখা দেয়।

কারো ম্যালেরিয়া সন্দেহ হলে প্রথমবার পরীক্ষায় যদি ম্যালেরিয়ার জীবাণু পাওয়া না যায়, তবে পর পর তিন দিন পরীক্ষাটি করা উচিত। একান্তই যদি ম্যালেরিয়া সনাক্ত হয়, তাহলে দেরি না করে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা উচিত। এই রোগ নিরাময়ে পাইপেরাকুইনের সমন্বয়ে তৈরি ‘আর্টেমিসিনিন’ নামের ঔষধটি বেশ কার্যকরী। দেশের প্রায় সকল হাসপাতালে (যেমন- থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, কমিউনিটি ক্লিনিক অথবা জেলা হাসপাতালগুলোতে) চিকিৎসা পাওয়া যায়।

চিকিৎসা

রোগের উপসর্গ দেখা দিলে দেরি না করে দ্রুত চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। সংক্রমণের তীব্রতা আর ম্যালেরিয়ার ধরণের উপর এই রোগের চিকিৎসা নির্ভর করে। সাধারণতঃ তীব্রতা কম হলে ম্যালেরিয়া-প্রতিকারের জন্য মুখে খাওয়ার ঔষধ দেওয়া হয়। কিন্তু সেরিব্রাল ম্যালেরিয়ার (মারাত্মক ম্যালেরিয়া) ক্ষেত্রে রোগীকে দ্রুত হাসপাতালে ভর্তি করে ইঞ্জেকশনের মাধ্যমে চিকিৎসা প্রদান করা হয়।

এ রোগ প্রতিরোধের জন্য কার্যকরী টিকা এখনো বিশ্বব্যাপী বহুল প্রচলিত নয়। তাই অন্যান্য প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা গ্রহণই এ রোগ প্রতিরোধের একমাত্র উপায়।

উপযুক্ত চিকিৎসার মাধ্যমে ম্যালেরিয়া থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। ম্যালেরিয়া রোগে অধিকাংশ মৃত্যুর কারণ হলো সময়মতো রোগ সনাক্ত না হওয়া এবং চিকিৎসায় বিলম্ব করা। সেজন্য জনসচেতনতা বাড়াতে হবে। রোগের লক্ষণ দেখা দিলে জটিলতা সৃষ্টির আগেই চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি।

ম্যালেরিয়া প্রতিরোধে করণীয়

    • মশাবাহিত রোগ থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার ব্যপারে সচেতন হতে হবে। মশার কামড় থেকে দূরে থাকাই এ রোগ প্রতিরোধের উপায়।
    • দিনে বা রাতে ঘুমানোর সময় অবশ্যই মশারি বা কয়েল ব্যবহার করতে হবে। দরজা-জানালায় মশা প্রতিরোধক জাল, শরীরে প্রতিরোধক ক্রিম, ঘরে মশা মারা স্প্রে ব্যবহার করুন।
    • ঘরের আশপাশে কোথাও পানি জমে যেন মশা বংশবিস্তার না করতে পারে; সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
    • মশাবহুল স্থানে কীটনাশক বা কেরোসিন ছিটিয়ে দেওয়া যেতে পারে।
    • ম্যালেরিয়াপ্রবণ এলাকায় যাওয়ার প্রয়োজন হলে চিকিত্সকের পরামর্শ নিয়ে ম্যালেরিয়া প্রতিরোধী ঔষধ সঙ্গে রাখা উচিত।

ডাঃ মোঃ আজিজুল হক (আব্দুল্লাহ)
প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (মেডিসিন বিভাগ)
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *