বিশ্ব হার্ট দিবস
বর্তমান বিশ্বে হৃদরোগ মৃত্যুর এক নম্বর কারণ। হৃদরোগ বলতে মূলতঃ হার্ট এ্যাটাক ও উচ্চ রক্তচাপজনিত হার্টের অসুখকে বুঝায়। এছাড়া উন্নয়নশীল দেশগুলোতে বাতজ্বরজনিত ভাল্বের হৃদরোগও একটি বড় সমস্যা। হৃদরোগ একটি অসংক্রামক ব্যাধি। উচ্চ রক্তচাপজনিত হৃদরোগ, ব্রেইন স্ট্রোক, ডায়াবেটিস হচ্ছে অসংক্রামক ব্যাধিসমূহের অন্তর্ভুক্ত। ২০২৫ সালের মধ্যে ২৫ ভাগ বৈশ্বিক অসংক্রামক ব্যাধি মৃত্যু হ্রাসের জন্য ২০১২ সাল থেকে ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন (World heart federation) বিশ্বব্যাপী জনসচেতনতা বৃদ্ধিতে নানাবিধ কার্যক্রম গ্রহণ করে যাচ্ছে। ওয়ার্ল্ড হার্ট ফেডারেশন তিনটি বিষয়ের প্রতি দৃষ্টি রেখে নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে যা হচ্ছে স্বাস্থ্য ও মানবিক উন্নয়ন, পরিবেশ প্রকৃতির সুরক্ষা করে ধরণীকে বাসযোগ্য রাখা এবং ব্যক্তির সুপ্ত প্রতিভার বিকাশ। প্রতিবছর ২৯শে সেপ্টেম্বর ‘বিশ্ব হার্ট দিবস’ পালনের মাধ্যমে জনসম্পৃক্ততা ও জনসচেতনতা বৃদ্ধির মাধ্যমে হৃদরোগজনিত মৃত্যুর হার হ্রাসকল্পে হৃদরোগ বিষয়ক বিভিন্ন আলোচনা অনুষ্ঠান, সামাজিক, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার মাধ্যমে তুলে ধরছে। এবারের বিশ্ব হার্ট দিবসের স্লোগান হচ্ছে “হৃদয় দিয়ে হৃদয়কে ভালবাসুন” (Use Heart For Every Heart)। চিকিৎসাবিজ্ঞানে আমরা জেনেছি মাতৃগর্ভে ভ্রুণের ৫-৬ সপ্তাহে হার্টবিট বা হৃদস্পন্দন দিয়ে জীবনের শুরু এবং হৃদস্পন্দনের স্তব্ধতা দিয়েই জীবনাবসান (It is the first and last sign of life)। এই প্রাসঙ্গিকতায় এবারের বিশ্ব হার্ট দিবসে হৃদয় দিয়ে হৃদয়ের যত্ন নেওয়াকে মূল্যায়িত করা হয়েছে। এতে করে যেন আমরা হৃদরোগ প্রতিরোধে হৃদয়ের প্রতি আরও যত্নশীল ও সচেতন হয়ে হার্টের সক্ষমতাকে আরও শক্তিশালী করে তুলতে পারি।
উচ্চ রক্তচাপকে চিকিৎসাবিজ্ঞানের ভাষায় হাইপারটেনশন বা High blood pressure বলা হয়। রক্তচাপ এর স্বাভাবিক মাত্রা হলো সিস্টোলিক চাপ ১১০-১৩০ মিঃমিঃ পারদ আর ডায়াস্টোলিক ৬০-৮০ মিঃমিঃ পারদ। এটি পৃথিবীব্যাপি গুরুতর স্বাস্থ্য ঝুঁকির প্রধান কারণ। উচ্চ রক্তচাপের কারণে হার্ট এ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, কিডনী ফেলিউর, হার্ট ফেলিউর, চোখের অন্ধত¦ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যগত মারাত্মক ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ায় উচ্চ রক্তচাপ ও ডায়াবেটিসের প্রাদুর্ভাব খুব বেশী। এই দুটি রোগই করোনারী হৃদরোগ, স্ট্রোক ও কিডনীরোগের আশংকা বাড়িয়ে দেয়। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপ হার্ট এ্যাটাক এবং স্ট্রোকের মত ভয়ানক রোগের সৃষ্টি করে; এমনকি অকালমৃত্যুও ঘটাতে পারে। এই ঝুঁকি হ্রাস করার জন্য উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখা প্রয়োজন। যথাসময়ে রোগ নির্ণয় যথাযথ চিকিৎসা এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ জটিলতার ঝুঁকি কমিয়ে দেয়। উচ্চ রক্তচাপের জটিলতার চিকিৎসা অধিক ব্যয়বহুল ও অনেকের সাধ্যের বাইরে। সারা বিশ্বে এই রোগটি এক নম্বর মৃত্যুর কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এবং প্রতিবছর প্রায় ১০ মিলিয়ন (এক কোটি) মানুষ মারা যায়। ৫০% মানুষ যাদের উচ্চ রক্তচাপ আছে তা তারা জানে না। যখন তারা জানতে পারে উচ্চ রক্তচাপের কারণে ব্রেইন স্ট্রোক বা হার্ট এ্যাটাক নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। উচ্চ রক্তচাপের কারণে চোখের অন্ধত্ব, চোখের মধ্যে রক্তক্ষরণ এবং কিডনী ফেলিউর হতে পারে। প্রায় ৯৫ ভাগেরও বেশীক্ষেত্রে উচ্চ রক্তচাপের নির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যায় না। এই ধরণের উচ্চ রক্তচাপকে প্রাইমারী হাইপারটেনশন বলে। খুব স্বল্প সংখ্যক লোকের মধ্যে নির্দিষ্ট কোনো কারণ পাওয়া যেতে পারে যার যথাযথ চিকিৎসা করলে রক্তচাপ স্বাভাবিক হয়ে যায়। এই ধরণের উচ্চ রক্তচাপকে সেকেন্ডারী হাইপারটেনশন বলা হয়। বেশরিভাগ ক্ষেত্রে সুনির্দিষ্ট কোনো কারণ না থাকলেও কতকগুলো বিষয় উচ্চ রক্তচাপ রোগের সৃষ্টিতে বিশেষ ভূমিকা পালন করে এবং উচ্চ রক্তচাপের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয় যার মধ্যে রয়েছে অস্বাস্থ্যকর খাদ্যভ্যাস, স্থুলতা, ধূমপান এবং তামাকজাতীয় দ্রব্যের ব্যবহার, যথেষ্ট পরিমাণ ফলমূল ও শাক-সবজি না খাওয়া, কায়িক শ্রম না করা, মানসিক চাপ, অতিরিক্ত লবণ খাওয়া ইত্যাদি। উচ্চ রক্তচাপ নিশ্চিন্ত হলে চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। চিকিৎসক রোগীর উচ্চ রক্তচাপ নিশ্চিত করে ঔষধ লাগবে কি না ঠিক করবেন এবং উচ্চ রক্তচাপের কারণে অন্যান্য অঙ্গে যেমন – হার্ট, কিডনী ও মস্তিষ্কে বিরূপ প্রভাব পড়েছে কি না তা কিছু পরীক্ষা করে নির্ধারণ করবেন। উচ্চ রক্তচাপের লক্ষণসমূহ বেশীরভাগক্ষেত্রে অনুপস্থিত থাকে। সেকারণে উচ্চ রক্তচাপকে নীরব ঘাতক বলা হয়। মাথা ব্যথা কিংবা ঘাড় ব্যথা এসব উচ্চ রক্তচাপের কোনো আবশ্যিক সাধারণ উপসর্গ নয় তাই রোগ নির্ণয়ের জন্য নিয়মিত রক্তচাপ মাপার মাধ্যমেই উচ্চ রক্তচাপ বেশীরভাগক্ষেত্রে নির্ণীত হয়ে থাকে। যদি উচ্চ রক্তচাপের জন্য নিয়মিত উপযুক্ত চিকিৎসা না নেওয়া হয় তাহলে স্ট্রোক, হার্ট এ্যাটক, কিডনী রোগ, চোখে রক্তক্ষরণ এবং অন্ধত্ব দেখা দিতে পারে। এমনকি মৃত্যুও ঘটতে পারে। উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শমত ঔষধ নিয়মিত সেবন করতে হবে এবং জীবনাচারে পরিবর্তন আনতে হবে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার ১৮% মানুষ উচ্চ রক্তচাপে ভুগছে। বাংলাদেশ ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন ও জাতীয় হৃদরোগ ইন্সটিটিউট, ঢাকার একটি গবেষণায় বাংলাদেশে উচ্চ রক্তচাপের হার ২০-২৫%। অর্থাৎ বাংলাদেশে প্রতি ৫ জনের মধ্যে একজন উচ্চ রক্তচাপের রোগী।
ডায়াবেটিস মেলিটাস একটি হরমোনজনিত বিপাকীয় (মেটাবলিক) রোগ। দেহের অগ্ন্যাশয় যদি যথেষ্ট পরিমানে ইনসুলিন তৈরী করতে না পারে বা দেহকোষ যদি উৎপন্ন ইনসুলিন ব্যবহারে অকার্যকর হয় তাহলে খাদ্যের কার্বোহাইড্রেট (শর্করা) বিপাকে অকার্যকর হয়ে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় যেটাকে বলা হয় ডায়াবেটিস বা বহুমূত্র রোগ। ফলে রক্তে গ্লুৃকোজ বা শর্করার অসামঞ্জস্যতা দেখা দেয়। ডায়াবেটিস কথাটি এখন সবার কাছে সুপরিচিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে ডায়াবেটিস হলো বিপাকীয় মহামারী রোগ। এটি এমন একটি রোগ যা কখনোই সারে না। কিন্তু এই রোগকে সহজেই নিয়ন্ত্রণে রেখে স্বাভাবিক জীবন যাপন করা যায়। আমরা যখন শর্করা জাতীয় খাবার খাই তা রক্তের মধ্যে ভেঙ্গে গ্লুকোজে পরিণত হয় এবং ইনসুলিন হরমোন এই গ্লুকোজকে দেহকোষের মধ্যে পৌঁছে দেয় আর দেহকোষ এই গ্লুকোজ থেকে শক্তি উৎপাদন করে। যখন মানুষের শরীরে ইনসুলিন হরমোনের নিঃসরণ মাত্রা কমে যায় বা অকার্যকর হয় তখন এই গ্লুকোজ আর দেহকোষ ব্যবহার করতে পারে না ফলে রক্তে গ্লুকোজের মাত্রা বেড়ে যায় যার অপর নাম বহুমূত্র রোগ। এই বহুমূত্র রোগের কারণে হার্ট এ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, ডিজলিপিডিমিয়া এবং দেহের রক্তনালীতে ব্লক (এ্যাথেরোস্কে¬রোসিস) তৈরী করে। ডায়াবেটিসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে প্রায় দ্বিগুণ কার্ডিওভাস্কুলারজনিত মৃত্যুর আশংকা থাকে। বিশ্বে প্রতি ১১ জনে একজন ডায়াবেটিসে আক্রান্ত এবং প্রায় ৪২৫ মিলিয়ন ডায়াবেটিস রোগী যা ২০৪৫ সালে ৬২৯ মিলিয়ন হবে। প্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে ৯০% রোগী টাইপ-২ ডায়াবেটিসে এবং এর সাথে কার্ডিওভাস্কুলারজনিত রোগের কারণে কমপক্ষে ১২ বছর আয়ু কমিয়ে দেয়।
ট্রান্সফ্যাট কথাটি এখন বহুল প্রচলিত ও পরিচিত। মূলতঃ এটি একটি ট্রান্স অসম্পৃক্ত ফ্যাটি এসিড। আমাদের খাদ্যাভাসে দু’ধরণের ট্রান্সফ্যাট পাওয়া যায়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট ও শিল্পোৎপাদিত (iPHO-Industrialized partially hydroganeted Oil) ট্রান্সফ্যাট। গরু ছাগলের মাংস, দুধ ও দুগ্ধজাতীয় খাবার, ঘী, মাখন ইত্যাদিতে স্বল্পমাত্রায় ট্রান্সফ্যাট পাওয়া যায়। যেটা একটি নির্দিষ্ট মাত্রা পর্যন্ত ক্ষতিকারক নয়। আর কৃত্রিমভাবে শিল্পোৎপাদিত আংশিক জারিত তেল (iPHO) অর্থাৎ উদ্ভীদ তেলের (পাম, সয়াবিন) সাথে হাইড্রোজেন (হাইড্রোজেনেশন) যুক্ত করলে তেল জমে যায় এবং ট্রান্সফ্যাটে পরিণত হয়। এই আংশিক জারিত হাইড্রোজেনেটেড তেলই শিল্পোৎপাদিত ট্রান্সফ্যাটের প্রধান উৎস যেমন – ডালডা ও বনস্পতি ঘি যার মধ্যে ২৫-৪৫% পর্যন্ত ট্রান্সফ্যাট থাকে। বেকারীতে উৎপাদিত খাবারের স্বাদ, ঘ্রাণ ও স্থায়িত্ব বাড়ানোর জন্য ট্রান্সফ্যাট ব্যবহৃত হয়। আবার খরচ কমানোর জন্য হোটেল, রেস্টুরেন্ট ও স্ট্রীট ফুডের দোকানগুলোতে সিঙ্গাড়া, সমোচা, পুরি, জিলাপী, চিকেন ফ্রাইসহ বিভিন্ন ভাজাপোড়া খাবার তৈরীতে একই তেল বারবার ব্যবহার করা হয় ফলে এসব খাবারে ট্রান্সফ্যাটের মাত্রা বহুগুণ বেড়ে যায়। ট্রান্সফ্যাটযুক্ত এসমস্ত খাবার খেলে হার্টের রক্তনালী ব্লক হওয়া, ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ ও ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি বহুগুণ বৃদ্ধি পায়। ইন্ডিয়ার জার্নাল অব পাবলিক হেলথ (২০২১) প্রকাশিত নিবন্ধে বলা হয়েছে ট্রান্সফ্যাট রক্তনালীতে প্রদাহ তৈরী করে এবং হার্ট এ্যাটাক, ব্রেইন স্ট্রোক, ডায়াবেটিস ও অন্যান্য দূরারোগ্য ব্যাধির ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়। ট্রান্সফ্যাটের নিরাপদ মাত্রা দৈনিক দুই শতাংশের নীচে। দুই শতাংশের বেশী ট্রান্সফ্যাটযুক্ত খাদ্য হৃদরোগের ঝুঁকি ২৩% পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে, বিশ্বে ট্রান্সফ্যাটজনিত হৃদরোগে মৃত্যুর প্রায় দুই তৃতিয়াংশ ঘটে বিশ্বের ১৫টি দেশে যার মধ্যে বাংলাদেশও অন্যতম। ট্রান্সফ্যাট নয় এমন তেল বাংলাদেশে রান্নার কাজে ব্যবহার করা হয় (যেমন – রেস্টুরেন্ট ও স্ট্রীট ফুডের দোকানে পিয়াজু, বেগুনী, চপ, জিলাপী, সিঙ্গাড়া, পুরি ভাজাতে) এবং পুনঃ পুনঃ ব্যবহারে এই তেল ক্ষতিকারক ট্রান্সফ্যাটে রুপান্তরিত হয় যা নীরব ঘাতক রূপে দেহের রক্তনালীতে ব্লক তৈরী করে। ফলে স্ট্রোক বা হার্ট এ্যাটকের সম্ভাবনা বেড়ে যায় এবং মৃত্যুও ঘটতে পারে।
হার্ট এ্যাটাক (acute coronary syndrome) হার্টের (করোনারী) রক্তনালীতে কোলেস্টেরলের আস্তরণ পড়ে রক্তনালীকে সংকুচিত করে দেয় ফলে হার্টে রক্তপ্রবাহ ব্যাহত হয়। ফলশ্রুতিতে পরিশ্রমজনিত কারণে বুকে ব্যথা হয় কিন্তু বিশ্রামে থাকা অবস্থায় কোনো ব্যথা থাকে না। এই অবস্থাটিকে ক্রনিক ষ্ট্যাবল এ্যানজাইনা বলে। কিন্তু যদি বিশ্রামরত অবস্থায় হঠাৎ করে তীব্র আকারে বুকে ব্যথা শুরু হয় এবং ৩০ মিনিটেরও বেশী সময় ধরে স্থায়ী হয় তখন সে অবস্থাকে acute coronary syndrome বা হার্ট এ্যাটাক বলে। এটি রক্তনালীতে atherosclerotic plaque ভেঙ্গে গিয়ে রক্তজমাট বাঁধার কারণে সম্পূর্ণ রক্ত চলাচল বন্ধ করে দেয়। ফলশ্রুতিতে হার্টের মাংসপিন্ড অকেজো হয়ে যায়। হার্ট এ্যাটাকের কারণসমূহ হচ্ছে বংশে হার্ট এ্যাটাকের প্রবণতা, উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, ডিজলিপিডিমিয়া (রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য), ধূমপান, স্থুলতা, মানসিক চাপ ইত্যাদি। করোনারী হৃদরোগ বা ব্লকজনিত কারণে পৃথিবীব্যাপী প্রায় ৭০ লক্ষ (৭ মিলিয়ন) মৃত্যু ঘটে এবং এই হার্ট এ্যাটাকের ৯০ ভাগ কারণকেই নিয়ন্ত্রণ বা পরিবর্তন করা যায় জীবনাচারের মাধ্যমে। হার্ট এ্যাটাকের প্রায় ২৫ ভাগ রোগীরই আকষ্মিক মৃত্যু ঘটে থাকে বা হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার আগেই মারা যায়। কার্ডিওভাস্কুলার রোগজনিত কারণে বিশ্বব্যাপী যত মৃত্যু হয় তার ৭৫ ভাগই ঘটে অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে। কাজেই হার্ট এ্যাটাক থেকে নিজেকে রক্ষার জন্য এই সমস্ত কারণগুলো সম্পর্কে সচেতন থেকে তা পরিহার করে চলা। কারণ হার্ট এ্যাটাক হলে তাৎক্ষণিকভাবে মৃত্যু ঘটতে পারে ও অন্যান্য মারাত্মক জটিলতা দেখা দিতে পারে। হৃদরোগের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল। কাজেই হার্ট এ্যাটাকের ঝুঁকিসমূহ এড়ানোর জন্য সময়মত যথাযথ চিকিৎসা ও স্বাস্থ্যকর জীবনাচারে অভ্যস্ত হতে হবে।
ডিজলিপিডিমিয়া (রক্তে কোলেস্টেরলের আধিক্য) রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রাধিক্য বিশেষ করে এল.ডি.এল ও ট্রাইগ্লিসারাইড কোলেস্টেরল মাত্রাতিরিক্ত অবস্থাকে ডিজলিপিডিমিয়া বলে। এর ফলে দেহের রক্তনালীতে কোলেস্টেরল চর্বি জমা হয়ে atherosclerotic block তৈরী হয়। ফলশ্রুতিতে দেহের গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গসমূহের রক্তনালী যেমন – হার্ট, মস্তিষ্ক, চোখ, কিডনী, পেট ও পায়ের রক্তনালী ইত্যাদিতে রক্তপ্রবাহ বাধা প্রাপ্ত হয় এবং কোনো এক পর্যায়ে এসমস্ত অঙ্গসমূহ ক্ষতিগ্রস্ত বা বিকল হয়ে যেতে পারে। সাধারণতঃ সম্পৃক্ত চর্বি যার উৎস প্রাণীজ চর্বি বিশেষ করে গরু-খাসীর মাংস, ঘি, মাখন ইত্যাদি বেশী খেলে রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা বেড়ে যায়। আর যাদের বংশে এর ইতিহাস রয়েছে তাদের অতি অল্প বয়সে এই atherosclerotic block তৈরী হয়ে অকাল মৃত্যু ঘটাতে পারে। সঙ্গত কারণে আমাদের খাদ্যাভাসে অতিরিক্ত সম্পৃক্ত চর্বিযুক্ত খাবার পরিমিতভাবে খেতে হবে বা পরিহার করতে হবে। রক্তের কোলেস্টরল এর স্বাভাবিক মাত্রা হচ্ছে পূর্ণমাত্রা (total) ২০০ মিঃগ্রাঃ প্রতি ডেসিমিটার এইচডিএল (ভাল) কোলেস্টেরল ৩৫ মিঃগ্রাঃ প্রতি ডেসিলিটার, এলডিএল বা খারাপ কোলেস্টরল ১৩০ এবং ট্রাইগ্লিসারাইড (খারাপ) কোলেস্টরল ১০০ মিঃগ্রাঃ/প্রতি ডেসিলিটার। ভারতবর্ষসহ দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার লোকজনের মধ্যে ভালো কোলেস্টেরলের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে কম পক্ষান্তরে খারাপ কোলেস্টেরলের মাত্রা উল্লেখযোগ্য হারে বেশী এবং শহরাঞ্চলীয় বসবাসকারী জনগণের মাত্রা এর মাত্রা প্রায় ৫-৯ গুণ। সাধারণতঃ ডিজলিপিডিমিয়া ৩০-৪০ বছর বয়সের পরে দেখা দেয় কিন্তু একটি গবেষণার আশঙ্কাজনক পূর্বাভাস হচ্ছে দ্বিতীয় দশকেই (১০-১৯ বছর) অনেকে এতে আক্রান্ত হচ্ছে।
স্থুলতা হার্ট এ্যাটাকের একটি বড় ঝুঁকি। স্থুলতায় উচ্চ রক্তচাপ, ডিজলিপিডিমিয়া, ডায়াবেটিস, হার্ট এ্যাটাক, অস্টিওআর্থাইটিস, বিভিন্ন ধরণের ক্যান্সার ও চলাফেরায় সমস্যা তৈরী করে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার মতে বর্তমানে সারা বিশ্বে অতি ওজন (overweight) প্রাপ্তবয়ষ্ক মানুষের সংখ্যা ১৯০ কোটি যার মধ্যে মোটা (obese) মানুষের সংখ্যা ৬৫ কোটি। ১৯৭৫ সালের তুলনায় ২০১৬ সালে স্থুল মানুষের সংখ্যা প্রায় তিন গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। আর ২০১৭ সালে ওবেসিটি ঝুঁকিজনিত অকাল মৃত্যুর সংখ্যা ছিল ৪৭ লক্ষ। ক্যালরী গ্রহণ ও ব্যয়ের সাথে স্থুলতার নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। প্রয়োজনের তুলনায় যদি অতিরিক্ত ক্যালরী গ্রহণ করা হয় তাহলে দেহের ওজন বেড়ে যায়। যত বেশী কায়িক শ্রম করা হয় তত বেশী ক্যালরীর প্রয়োজন হয়। কায়িক শ্রমের লেভেল হলো PAL (Physical Activity Level) যা দিক নির্দেশনা দেয় কতটা এনার্জি খাবারের মাধ্যমে গ্রহণ করতে হবে এবং এটি ১.২ – ১.৯। সারাদিন যে পরিমাণ এনার্জি প্রয়োজন হয় তা পূরণের জন্য যে পরিমাণ ক্যালরী খাওয়ার দরকার তাকে বলা হয় Total Energy Requirement (TER)। Body Mass Index (BMI) এই ফর্মূলা দ্বারা দেহের আদর্শ ওজন, অতিরিক্ত ওজন ও স্থুলতা নির্ণয় করা হয়। স্বাভাবিক BMI হলো ১৮.৫০-২৪.৯ এবং এটি আদর্শ ওজনের নির্দেশক। ২৫-২৯.৫০ পর্যন্ত যাদের BMI ওজন তাদেরকে অতি ওজন (overweight) এবং ৩০ BMI এর বেশী হলে তাকে স্থুল বা obese বলা হয়। ৪০ এর বেশী BMI হলে একে অতি মারাত্মক স্থুলতা বলা হয়। অতএব আমাদের সবার আদর্শ ওজন ১৮.৫০-২৪.৯ BMI এর মধ্যে রাখার জন্য সচেষ্ট থাকতে হবে যার ফলশ্রুতিতে স্থুলতাজনিত জটিলতা থেকে মুক্ত থাকতে পারবো।
বায়ু দূষণ হার্ট এ্যাটাক, হৃদরোগ, ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি ও মৃত্যু বাড়ায়। আমরা বাংলাদেশীরা এ বিষয়ে একেবারে অসচেতন। ১২ মাইক্রো গ্রাম সুক্ষ্ম কণা (১টি সুক্ষ্ম কণা = ২.৫ মাইক্রোন) প্রতি ঘনমিটার বাতাসে থাকলে সেটাকে বায়ুদূষণ বলছে American Environmental Protection Agency। এই দূষণে হৃদরোগ হার্ট এ্যাটাক ও ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি কয়েকগুণ বাড়ায়। পরিবেশ উন্নয়নে এখনই সময় আমাদের সচেতন হতে হবে এবং পরিবেশ বিধ্বংসী কার্যকলাপ থেকে বিরত থাকার জন্য প্রয়োজন রাষ্ট্রীয় কার্যক্রম তৎপরতা বৃদ্ধি।
বিশ্বে প্রতিবছর হৃদরোগ ও স্ট্রোকের কারণে প্রায় ১৮.৬ মিলিয়ন জীবনাবসান ঘটে যার অধিকাংশ মৃত্যু ব্যক্তির স্বাস্থ্য সচেতনতার দ্বারা প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই হার্ট সুস্থ রাখতে স্বাস্থ্যকর জীবন-যাপন এবং প্রতিরোধমূলক স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। আমরা সবাই হৃদরোগের ঝুঁকিসমূহ সম্পর্কে সচেতন হই, হার্টের সুরক্ষায় স্বাস্থ্যসম্মত সুষম খাবার খাই। ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য বর্জন করি। নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম ও ব্যায়াম করি। চিকিৎসকের পরামর্শ মেনে চলি। হৃদরোগের চিকিৎসা এবং এর প্রতিরোধে আমরা সবাই সদা সর্বদা সচেতন থাকি।
অধ্যাপক ডাঃ এম এ খালেক
অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (কার্ডিওলজী)
ইসলামী ব্যাংক মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল, রাজশাহী
কনসালট্যান্ট, জমজম ইসলামী হাসপাতাল, রাজশাহী