এন্ডোমেট্রিওসিস (Endometriosis)
(এক নীরব কষ্টের নাম)
গাইনোকোলজিক্যাল সমস্যার মধ্যে একটি উল্লেখযোগ্য সমস্যা এন্ডোমেট্রিওসিস। প্রাপ্ত বয়ষ্ক নারীদের প্রায় ১০-১৫ শতাংশ নারী এই রোগে আক্রান্ত হয়ে থাকেন। ক্রনিক পেলভিক পেইন অর্থাৎ তলপেটের দীর্ঘমেয়াদী ব্যথায় আক্রান্ত নারীদের ৭০ শতাংশেরই ব্যথার কারণ এই এন্ডোমেট্রিওসিস রোগ। বালিকা বয়স থেকে শুরু হলেও এটি শনাক্ত হতে অনেকসময় ৯-১০ বছর লেগে যেতে পারে। তলপেটে অন্যান্য অঙ্গের কারণেও ব্যথা হয়ে থাকে বলে এই রোগ শনাক্ত করতে দেরি হয়।
জরায়ুর এন্ডোমেট্রিয়াল ক্যাভিটির বাইরে এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু জন্মানোকে এন্ডোমেট্রিওসিস বলা হয়। ডিম্বাশয়, জরায়ুর পেছন, খাদ্যনালী, মূত্রথলি ও মূত্রনালী, ফুসফুসের পর্দা, নাভি, অপারেশনের কাটা জায়গায়ও হতে পারে এন্ডোমেট্রিওসিস।
ঋতুচক্রের সময় জরায়ুর ভেতর মাসিকের রক্ত তৈরি হয়ে প্রতি মাসে যোনিপথে বেরিয়ে আসে; কিন্তু এই রোগে (এন্ডোমেট্রিওসিস) মাসিকের রক্ত বের হওয়ার কোনো রাস্তা থাকে না। ফলে সেখানে প্রতি মাসিকেই রক্ত জমতে থাকে এবং মাসিকের সময় তীব্র ব্যথা হয়। প্রতিবার মাসিকে জমতে থাকা রক্তের সঙ্গে আশপাশের অন্যান্য কোষগুলোর বিরূপ প্রতিক্রিয়া হয় ও রক্ত জমে জমে ডিম্বাশয়ে থলির মতো তৈরি হয়, যাকে চকোলেট সিস্ট বলে। এছাড়া বিভিন্ন অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ যেমন – খাদ্যনালী, মূত্রথলি, ডিম্বাশয়, ডিম্বনালী, জরায়ু সব একে অন্যের সঙ্গে লেগে থাকে। ফলে বাচ্চা হতে অসুবিধা হয়।
এন্ডোমেট্রিওসিসের উপসর্গ
-
- মাসিকের সময় তলপেটে বা শ্রোণী অঞ্চলে প্রচন্ড ব্যথা (dysmenorrhea)। মাসিকের দু-তিন দিন আগে থেকে শুরু হতে পারে যা মাসিকের সময় তীব্র আকার ধারণ করে। মাসিক শেষ হওয়ার পরও কয়েক দিন ব্যথা থেকে যায়।
- যৌনমিলনের সময় অসহ্য ব্যথা অনুভূত হওয়া (dyspareunia)।
- মাসিকের সময় অস্বাভাবিকভাবে প্রচুর রক্তপাত (মেনোরেজিয়া)।
- ঘন ঘন প্রস্রাবের চাপ আসা, মল-মূত্র ত্যাগের সময় ব্যথা হওয়া (dysuria)।
- ৪০-৬০ শতাংশ ক্ষেত্রে এর কারণে বন্ধ্যত্ব বা সন্তান ধারণে সমস্যা হতে পারে।

যাদের হতে পারে
- কারণ প্রধানতঃ অজানা।
- সাধারণতঃ ৩০ থেকে ৪০ বছর বয়সীদের বেশি হয়; তবে যেকোনো বয়সেই যে কেউ আক্রান্ত হতে পারে।
- ধনাঢ্য পরিবারের নারীদের এই রোগ বেশি হয়। কেন হয়? এর কারণ এখনো অজানা।
- কিশোরী মেয়েদের মাসিকের ব্যথা তীব্র হলে এন্ডোমেট্রিওসিস হতে পারে বলে সন্দেহ করা যেতে পারে।
- যাদের মা অথবা বোনদের এই রোগের ইতিহাস রয়েছে, তাদেরও আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা বেশি।
- যাদের সন্তান হয়নি বা বন্ধ্যত্ব আছে।
রোগ নির্ণয়
রোগীর সম্পূর্ণ ইতিহাস ও শারীরিক পরীক্ষা এন্ডোমেট্রিওসিস শনাক্তকরণে সাহায্য করে। রোগটি সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার জন্য এবং এই রোগ কতটা ছড়িয়েছে তা দেখার জন্য কিছু পরীক্ষা-নিরীক্ষা করারও প্রয়োজন হয়। যেমন –
- আলট্রাসনোগ্রাফিঃ এই পরীক্ষার মাধ্যমে এন্ডোমেট্রিয়াল টিস্যু কোথায় আছে তা জানা যায়। ডিম্বাশয়ের চকোলেট সিস্ট ডায়াগনসিস আলট্রাসনোগ্রাফির মাধ্যমে সম্ভব।
- ল্যাপারোস্কপিঃ একমাত্র ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে সঠিকভাবে সমস্যাটি নির্ণয় করা যায়। সরাসরি দেখে রোগটি প্রাথমিক অবস্থায়ই শনাক্ত করা সম্ভব।
এন্ডোমেট্রিওসিসের চিকিৎসা
(ক) ঔষধের মাধ্যমে চিকিৎসাঃ নিয়ম মেনে নিয়মিত চিকিৎসকের পরামর্শ নিলে রোগটি যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণে থাকে। ঔষধ সেবনের দ্বারা এটি নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব। চিকিৎসক সাধারণতঃ কিছু পেইন কিলার দিয়ে ব্যথা প্রশমিত করে থাকেন। এতে কাজ না হলে বিভিন্ন হরমোন প্রয়োগ করে থাকে। ব্যথা কমতে থাকে এবং ধীরে ধীরে রোগটি সারতে থাকে ও সিস্ট ছোট হয়ে যায়। স্বল্পব্যয়ে চিকিৎসা করার জন্য কখনও কখনও চিকিৎসক জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি খাওয়ারও পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এছাড়া আরও বিভিন্ন ধরণের ঔষধ দিয়েও চিকিৎসা করা হয়, এতে রোগের উপশম হয়; কিন্তু চিকিৎসা চলাকালে বাচ্চা হওয়া সম্ভব নয়।
উল্লেখ্য যে, বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদী পার্শ্বপ্রতিক্রিয়ার কারণে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ঔষধের সেবন সম্পূর্ণরূপে নিষেধ।
(খ) অপারেশনের মাধ্যমে চিকিৎসাঃ চিকিৎসায় এন্ডোমেট্রিওসিস রোগ পুরোপুরি সারিয়ে তোলা যায় না। কারণ এটি একটি recurrent disease; অর্থাৎ বারবার হতে পারে। তাই দুই ডিম্বাশয়সহ জরায়ু অপসারণ (complete hysterectomy) করাই এর কার্যকর চিকিৎসা। যে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে এন্ডোমেট্রিওসিস হয়েছে সেগুলো ধীরে ধীরে টিউমারের আকার ধারণ করতে পারে। তখন তা অপারেশনের মাধ্যমে অপসারণ করতে হয়। কখনও কখনও দুই ওভারি ও জরায়ু অপসারণ করা হয় (যাদের বয়স বেশি এবং বাচ্চা আছে তাদের জন্য প্রযোজ্য, যাদের বয়স কম এবং বাচ্চা হয়নি তাদের জন্য এটা করা সম্ভব নয় তাই এব্যপারে চিকিৎসকের পরামর্শ গ্রহণ করাই উত্তম)।
(গ) বন্ধ্যাত্বের চিকিৎসার মাধ্যমেঃ যাদের এন্ডোমেট্রিওসিস আছে তাদের ৫০ শতাংশেরই সন্তান হতে অসুবিধা হয়। পেট কেটে বা ল্যাপারোস্কপির মাধ্যমে তাদের চিকিৎসা করা হয়। তবে ল্যাপারোস্কপিই উত্তম চিকিৎসা পদ্ধতি। কখনও কখনও রোগ বেশি জটিল পর্যায়ে গেলে অপারেশন না করে চিকিৎসক টেস্টটিউব চিকিৎসা নেওয়ারও পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
এন্ডোমেট্রিওসিস প্রতিরোধে করণীয়
এন্ডোমেট্রিওসিস রোগ প্রতিরোধ করা না গেলেও এর জটিলতাগুলো প্রতিরোধ করা যায়।
- কিশোরীদের মাসিকের সময় ব্যথা হলে অবহেলা না করে অবশ্যই একজন স্ত্রী-রোগ বিশেষজ্ঞের (গাইনোকলজিস্টের) স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত।
- যাদের উপসর্গ সামান্য বা মেনোপজের সময় আসন্ন, তাদের তেমন কোনো চিকিৎসার প্রয়োজন নেই, কেবল নির্দিষ্ট সময় পরপর ফলো-আপ করলেই হবে।
- চিকিৎসকের পরামর্শমত নির্দিষ্ট মেয়াদে জন্ম নিয়ন্ত্রণের বড়ি বা প্রোজেস্টেরন হরমোন ঔষধের সেবন।
- বিবাহিত মেয়েরা যাদের বয়স কম ও সন্তান নেননি, তাদের এন্ডোমেট্রিওসিস থাকলে সন্তান নেওয়া উচিত, কেননা এ থেকে পরবর্তী সময়ে বন্ধ্যত্ব হতে পারে। অর্থাৎ বিবাহিত মেয়েদের সন্তান নিতে দেরি না করা।
গাইনী বিভাগ
জমজম ইসলামী হাসপাতাল, রাজশাহী
