যক্ষ্মা (Tuberculosis)
আজ ২৪ মার্চ ‘বিশ্ব যক্ষ্মা দিবস’। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য “Invest to End TB. Save Lives”.
যক্ষ্মা একটি সংক্রামক ব্যাধি যা প্রধানতঃ ফুসফুসকে আক্রান্ত করে। যক্ষ্মা বলতে সাধারণভাবে আমরা ফুসফুসের যক্ষ্মাকেই বুঝি। তবে ফুসফুস ছাড়াও শরীরের বিভিন্ন স্থানে যক্ষ্মা হতে পারে। যেমন – লসিকাগ্রন্থি, হাড় ও গিট, অন্ত্র, হৃৎপিন্ডের আবরণ ও মস্তিস্কের আবরণ ইত্যাদি। অতীতে মানুষের যক্ষ্মা ধরা পড়লে হতাশ হয়ে জীবন যাপন করত। কারণ তখন যক্ষ্মার কোন ঔষধ ছিল না। ফলে এই রোগকে মানুষ খুবই ভয় পেত। আজ আর সেই দিন নেই, নিয়মিত যক্ষ্মার ঔষধ সেবনে তা সম্পূর্ণরুপে নিরাময় হয়। যক্ষ্মা বাংলাদেশের জন্য একটি অন্যতম মারাত্মক জনস্বাস্থ্য সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের যে ৩০টি দেশে যক্ষ্মা রোগীর সংখ্যা সর্বাধিক, তাদের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান।
যক্ষ্মা রোগের উপসর্গ
- তিন সপ্তাহের অধিক সময় ধরে কাশি (শুকনো কিংবা কফযুক্ত) হওয়া।
- কাশির সঙ্গে রক্ত থাকতে পারে আবার না–ও থাকতে পারে।
- বুকে ব্যথা হওয়া।
- ওজন হ্রাস পাওয়া, অবসাদগ্রস্থতা, অরুচি।
- সন্ধ্যার সময় হালকা কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসা।
- রাতে ঘাম হওয়া। ইত্যাদি
উপরোক্ত উপসর্গ দেখা দিলে আমাদের দেশে অবশ্যই যক্ষ্মা সন্দেহ করে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা উচিত। এ ছাড়া শরীরে যেকোনো জায়গায় লসিকাগ্রন্থির স্ফীতি, মলত্যাগের অভ্যাসে পরিবর্তন, পেটব্যথা, বুকে বা পেটে পানি জমা, খিঁচুনি বা অজ্ঞান হয়ে পড়া ইত্যাদিও ফুসফুস বহির্ভূত সক্রিয় যক্ষ্মার উপসর্গ।
যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, তাদের এ ধরণের লক্ষণ দেখা দিলে দ্রুত চিকিৎসকের স্মরণাপন্ন হওয়া উচিত।
যাদের হতে পারে
- চিকিৎসকদের মতে, এই জীবাণু থেকে তাদেরই রোগ হওয়ার আশঙ্কা বেশি থাকে যাদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা দুর্বল।
রোগ নির্ণয়
এই রোগ নির্ণয়ে সাধারণতঃ কফ পরীক্ষা করা হয়, বুকের এক্স-রে, ত্বকের পরীক্ষা, সিটি স্ক্যান, কালচার টেস্ট এবং রক্তের বিভিন্ন ধরণের পরীক্ষা-নিরীক্ষাও করা হয়ে থাকে। পরীক্ষার রিপোর্ট দেখে এবং রোগীর লক্ষণ দেখে রোগটি নির্ণয় করা হয়।
যক্ষ্মা রোগের চিকিৎসা
যক্ষ্মা ভালো হওয়ার জন্য সাধারণতঃ ছয় মাসের চিকিৎসা করা হয়। প্রথম দুই মাস চার ধরনের ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তারপর চার মাস দুই ধরনের ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা করা হয়। তবে ঔষধ কিছুদিন খাওয়ার পর ৮০ ভাগ লক্ষণ চলে যায়। তখন রোগীরা মনে করেন হয়তো রোগটি সেরে গেছে। এই ভেবে ঔষধ খাওয়া বন্ধ করে দেয়। এতে ঝুঁকি আরও বেড়ে যায়। তখন চিকিৎসার ধরণ পরিবর্তন করার প্রয়োজন হয় এবং কখনও কখনও ৫টা ঔষধ দিয়ে চিকিৎসা শুরু করতে হয়। এভাবে চিকিৎসা করার পরও যদি রোগ না সারে তখন এমডিআর টিবি বৃদ্ধি পায়।
যক্ষ্মার চিকিৎসায় প্রথম দুই মাস যে চারটি ঔষধ দেওয়া হয় তা প্রত্যেক দিন খেতে হবে। একদিনও বাদ দেওয়া যাবে না এবং সঠিক ডোজে খেতে হবে। রোগীর যে ওজন আছে সেটি অনুযায়ী ঔষধের ডোজ চিকিৎসক নির্ধারণ করে দেন। এ ক্ষেত্রে তিনটি বাক্য (টার্ম) ব্যবহার করা হয়। অবিরাম, পরিমাণমতো এবং চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া কোনোদিন ঔষধের সেবন বাদ না দেওয়া।
যক্ষ্মার কিছু কিছু ঔষধ খেলে অনেকেরই চোখ হলুদ হয়ে যায়, বমি বমি ভাব হয়, প্রস্রাবের রংয়ের পরিবর্তন হতে পারে। তখন অনেক রোগী ঔষধের সেবন বন্ধ করে দেয় এবং ভাবে হয়তো তার জন্ডিস হয়েছে বা ঔষধটি হয়তো শরীরের সাথে যায়নি। এমতাবস্থায় অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে। যক্ষ্মার যদি সঠিক চিকিৎসা করা হয় তবে এটি বর্তমান সময়ে কোনো সমস্যাই নয়। কিন্তু ঠিক মতো চিকিৎসা না করার ফলে এর জটিলতা বাড়ছে।
যক্ষ্মার কারণ হচ্ছে, জনসংখ্যা বৃদ্ধি, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ। এ ছাড়া দরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে যক্ষ্মা হওয়ার প্রবণতা বেশি। পোশাক কারখানার কর্মীদের মধ্যে এই সমস্যা বেশি হতে দেখা যায়। কেননা বেশিরভাগ পোশাক কারখানাতে বাতাস চলাচলের অভাব থাকে, ফলে যক্ষ্মা হয়। অপুষ্টির কারণেও যক্ষ্মা হতে পারে।
ডায়াবেটিস থাকলে অনেক সময় যক্ষ্মা হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই ডায়াবেটিসকে খুব কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
যক্ষ্মা প্রতিরোধে করণীয়
- জন্মের পর পর প্রত্যেক শিশুকে বিসিজি টিকা দিতে হবে।
- পুষ্টিকর ও সুষম খাদ্য গ্রহণের মাধ্যমে শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়াতে হবে।
- বাসস্থানের পরিবেশ খোলামেলা, আলো-বাতাস সম্পন্ন হতে হবে।
- জনাকীর্ণ পরিবেশে বসবাস যথাসম্ভব পরিহার করতে হবে।
- ডায়াবেটিস জাতীয় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা হ্রাসকারী রোগের ক্ষেত্রে, সুষ্ঠু চিকিৎসা নিতে হবে।
- যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত রোগীকে সবসময় নাক মুখ ঢেকে চলাচল করতে হবে।
- যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত রোগীর সঙ্গে কথা বলার সময় একটি নির্দিষ্ট দূরত্ব বজায় রাখতে হবে।
- রোগী জীবাণুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত রোগীকে অন্য সবার থেকে একটু আলাদা রাখতে হবে।
- যক্ষ্মারোগে আক্রান্ত রোগীকে যেখানে সেখানে কফ ফেলা পরিহার করতে হবে।
ডাঃ মোঃ আজিজুল হক (আব্দুল্লাহ)
প্রাক্তন সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (মেডিসিন বিভাগ)
রাজশাহী মেডিকেল কলেজ