আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের আবির্ভাবের ফলে রোগ চিকিৎসা বর্তমানে অনেকটা প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়েছে। সৃষ্টির আদিকাল থেকেই মানুষ জরাগ্রস্ত হয় এবং এরূপ অসুখের একপর্যায়ে মানুষ শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে। যখন উন্নততর প্রযুক্তিনির্ভর চিকিৎসা অপ্রতুল ছিল তখন রোগীর চিকিৎসা অনেকটা বিভিন্ন উপায় উপকরণের মাধ্যমে রোগীকে আশ্বস্ত বা সান্তনা দানের পর্যায়ে সীমিত ছিল এবং অনেকক্ষেত্রে প্রাকৃতিক উপায়ে রোগ আরোগ্য হয়ে যেত অথবা রোগী মৃত্যুবরণ করত। উন্নত প্রযুক্তির অবর্তমানে রোগীর রোগ চিকিৎসার ব্যয়ভার অনেক কম ছিল এবং রোগীর প্রতি ডাক্তারের রোগীকে ভাল করতে না পারার মর্মবেদনা এবং পাশাপাশি ডাক্তারের প্রতি রোগীর বিশ্বাস, শ্রদ্ধা ও ভালবাসা অগাধ ছিল। কিন্তু অত্যন্ত দুঃখের বিষয় চিকিৎসার এই জায়গাটি আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থায় বিরাট শূন্যতার সৃষ্টি করেছে এবং এখন রোগী ডাক্তারের সম্পর্ক, আচরন, মনের দূরত্ব অনেক বেড়ে গেছে। তাই দেখা যাচ্ছে আমাদের দেশে চিকিৎসাকে কেন্দ্র করে অনেক হট্টগোল ও মারামারি। বিদেশে এর বহিঃপ্রকাশটি একটু ভিন্ন ধরনের। সেখানে ডাক্তারের বিরূদ্ধে ঠুনকো কারণে মামলা-মোকদ্দমা হয় যদিও তা দ্রুত নিস্পত্তি হয়ে যায়। আমাদের দেশের মত ডাক্তারকে গ্রেফতারের মত ঘটনা ঘটে না।
বিত্তবানদের এবং বড় বড় হাসপাতালের চিকিৎসার কথা বাদ দিলে বিপুল সংখ্যক সাধারণ মানুষ স্বল্পমূল্যে তেমন ভাল চিকিৎসা পাচ্ছে না। একটা পরিবারের চিকিৎসা ব্যয় এখন খাওয়া ও অন্যান্য খরচের সাথে পাল্লা দিয়ে প্রথম হওয়ার চেষ্টা করছে। ভাল চিকিৎসার আশায় দেশে-বিদেশে অনেক অর্থ ব্যয় করে নিঃস্ব হয়ে যাওয়ার ঘটনাও এখন বিরল নয়।
প্রযুক্তিগত উন্নতি আমাদের সিংহভাগ মনুষ্যত্বকে কেড়ে নিয়েছে। এমতাবস্থায় “Health for all”, “Community health” এমনকি সবার দোড়গোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌছানো, বাড়ি বাড়ি গিয়ে অসুস্থের খবরাখবর নেয়ার চটকদার শ্লোগানও আজ আর শোনা যাচ্ছে না। মনে হচ্ছে আমাদের কোন সমস্যা, অভাব অভিযোগ কিছু নেই, টাকা খরচ করার জায়গা পাচ্ছি না তাই যেখানে সেখানে চিকিৎসার নামে টাকা ব্যয় করছি।
প্রকৃত চিত্র কিন্তু এমন নয়। আমরা যারা রোগীর খুব কাছাকাছি থাকছি আমরা এসব প্রত্যক্ষ করে অত্যন্ত দুঃখ পেলেও কিছুই করতে পারছি না। কিছু করার হাতিয়ার আমাদের নেই। সারা পৃথিবী যেখানে একদিকে ছুটছে সেখানে দু-একজন এর বিপরীতে চলতে শুরু করলে স্বাভাবিকভাবে সেকেলে বা back dated আখ্যা পাওয়া ছাড়া নতুন প্রজন্মের কাছে আর কিছুই পাওয়ার নেই। এইসব দুঃখ নিয়েই রোগ নির্ণয় পদ্ধতির বইটি লিখতে শুরু করলাম।
প্রযুক্তির যত উন্নতিই হোক না কেন মানুষ থাকবে, মানুষের মন থাকবে, রোগ থাকবে, ডাক্তার থাকবে এবং চিকিৎসাও হবে। দেখা যায়, আমাদের যন্ত্র বা investigation যেটা বলতে পারে না অনেক ক্ষেত্রেই তা রোগীর ইতিহাস নিয়ে ও শারীরিক পরীক্ষা করে আমরা বলতে পারি। আর সিদ্ধান্ত গ্রহনের কথা তো বলাই বাহুল্য। যন্ত্র কখনোই রোগীর উপযোগী সিদ্ধান্ত দিতে পারবে না। একই ধরনের রোগ লক্ষণচিহ্ন রোগীভেদে চিকিৎসার তারতম্য হয় সেই সিদ্ধান্ত একজন ডাক্তারকেই নিতে হয়। ভাল ও চৌকস ডাক্তার অবশ্যই রোগীর মনমানসিকতা, আর্থিক অবস্থা, সামাজিক অবস্থান সর্বোপরি রোগের কতটুকু চিকিৎসা দিয়ে প্রকৃতঅর্থে রোগীর উপকারে লাগবে তা চিন্তাভাবনা করে চিকিৎসা দিবে, নিজ পকেটের দিকে তাকিয়ে নয়। টাকা ঠিকই আসবে। পৃথিবীর এই সংক্ষিপ্ত জীবনে স্বচ্ছলভাবে চলতে কত টাকারই বা একজন সৎ, চরিত্রবান চিকিৎসকের প্রয়োজন?
একজন চিকিৎসককে চিকিৎসা করতে হবে সম্পূর্ণ মানুষটাকে, তার কোন একটা অঙ্গের চিকিৎসা মাত্র নয়। এজন্য একটা প্রবাদ আছে ‘রোগীর চিকিৎসা কর, শুধুমাত্র রোগের নয়’।
চিন্তা-ভাবনার এই প্রেক্ষাপটে থেকে আমি এই রোগ নির্ণয় পদ্ধতি বইটি লিখছি। বাংলা ভাষায় এরূপ বই পূর্বে কেউ লিখেছেন কি না আমার জানা নেই। এই বইটি মেডিসিন ছাত্র, শিক্ষক উভয়ের উপকারে আসবে বলে আমি মনে করি।
১.১ রোগী ও ডাক্তার
রোগী হচ্ছে এমন একজন ব্যক্তি যে শারীরিক অথবা মানসিক কষ্টে ভুগছে এবং ডাক্তারও একজন ব্যক্তি যিনি এই কষ্ট লাঘবের উপায় সম্পর্কে জ্ঞান রাখেন এবং রোগীর কষ্ট লাঘবের কাজে সেই জ্ঞান তিনি প্রয়োগ করতে সক্ষম।
১.২ রোগী ও ডাক্তারের সম্পর্ক
বর্তমান পৃথিবীতে এই সম্পর্ক জটিল আকার ধারণ করলেও সংক্ষেপে আমাদের মনে রাখতে হবে এই সম্পর্ক হচ্ছে পরস্পরের প্রতি বিশ্বাস ও আস্থা (A relation to mutual trust)। এটা ছাড়া সঠিক চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব নয়।
ডাক্তার যেহেতু এখানে উত্তম অবস্থানে এবং রোগী দুর্বল একারণে ডাক্তারকে অহংকারী না হয়ে রোগীকে অত্যন্ত সহানুভূতির দৃষ্টিতে দেখতে হবে। মনে রাখতে হবে রোগী তার মতই একজন মানুষ। ডাক্তার নিজেও ওরকম একজন অসহায় রোগী হতে পারতেন সেটা মাথায় রাখতে হবে। কাজেই রোগীটিকে নিজের আপনজন মনে করে দরদ দিয়ে চিকিৎসা করতে হবে। কথায় ও ব্যবহারে (body language) যেন একটা মমত্ব প্রকাশ পায়। ডাক্তারকে রোগীর মনের খবর জানতে হবে এবং একজন ডিটেক্টিভ এর মত রোগীর বড়, ছোট এবং যাবতীয় প্রয়োজনীয় লক্ষণচিহ্নাদি খুঁজে বের করে সঠিক পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে নির্ভুল রোগ নির্ণয় করে ব্যবস্থাপত্র দিতে হবে।
তদ্রুপ রোগীকে ও রোগীর অভিভাবককে ডাক্তারের উপর বিশ্বাস রাখতে হবে। কোন ব্যপারে তার প্রতি মানসিকভাবে চড়াও (upper hand) হলে চলবে না। সেবাগ্রহণকারীকে অবশ্যই সেবাদানকারীর প্রতি কিছুটা হলেও অনুরক্ত ও সম্মান বজায় রেখে ও বিশ্বাস রেখে চলতে হবে। চিকিৎসককে সাধনার মাধ্যমে একজন দক্ষ চিকিৎসক হতে হবে। দক্ষতা ছাড়া শুধুমাত্র ভাল ব্যবহার রোগীর কোন কাজে আসবে না। তাকে অবশ্যই এক মনোবিজ্ঞানীর মত রোগীর মনের অবস্থা বুঝতে হবে।
১.৩ ডাক্তারের কাছে রোগীর আগমন
রোগীরা কি নিয়ে ডাক্তারের কাছে আসে? তারা কিছু শারীরিক লক্ষণ নিয়ে আসে এবং এইসব লক্ষণের উৎপত্তি বা ধরণ ধারণ সম্পর্কে সম্পূর্ণ অজ্ঞ বিধায় অনেক লক্ষণগুলোর মধ্যে কোনগুলি কম গুরুত্বপূর্ণ, কোনগুলি বেশী গুরুত্বের দাবীদার সে সম্পর্কে কিছুই জানে না। কাজেই ডাক্তারের কাছে রোগের ইতিহাস বর্ণনা করার সময় রোগীরা সব লক্ষণই বলার চেষ্টা করে এবং আশা করে যে ডাক্তার মনোযোগ দিয়ে সবকিছুই শুনবে এবং রোগ চিকিৎসা করাতে এসে ডাক্তারের কাছে তাকে ধমক-ধামক খেতে হবে না।
১.৪ ডাক্তারের করণীয়
প্রথমে রোগীকে সালাম দিয়ে কেমন আছেন বলে রোগীর দিকে তাকাবে এবং ডাক্তারকে হাসিমুখে তার এই বিষয়ে জ্ঞানহীন রোগীর কিছুটা এলোপাথাড়ি কম ও বেশী গুরুত্বসম্পন্ন সব ইতিহাসই ধৈর্য্যসহকারে শুনতে হবে এবং তার নিজস্ব জ্ঞান থেকে সেই ইতিহাস থেকে অপ্রয়োজনীয় অংশ বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ অংশগুলো আমলে নিয়ে রোগ নির্ণয়র চেষ্টা চালাতে হবে এবং কম গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো সম্পর্কে রোগীকে বুঝিয়ে বলতে হবে। কারন সে তো জানে না বা বুঝে না যে কোনগুলোর গুরুত্ব কতটুকু।
রোগী রোগ বিবরণ ঠিকমত না দিতে পারলে রোগীর সঙ্গে আসা অন্যান্যদের নিকট থেকে ইতিহাস নেওয়া যেতে পারে। রোগী অচেতন বা কমবুদ্ধিসম্পন্ন হলেও রোগীর কাছের লোকদের থেকে ইতিহাস নিতে হয়।
ডাক্তারের হাসিমুখের চেহারা দেখলে রোগী অবশ্যই তার নিজের মনের কথা নির্দ্বিধায় বলবে এবং রোগ চিকিৎসায় তা অনেক সহায়ক হবে। অনেকসময় সুবর্ণিত রোগ ইতিহাস অনেক বড় পরীক্ষার বিকল্পই শুধু নয়, রোগের উৎস সম্পর্কে বড় ধরনের পরীক্ষার (investigation) চাইতেও ভাল ধারণা একজন উৎসুক কৌশলী চিকিৎসাবিদ পেতে পারেন। শতকরা ৫০% এর বেশীরভাগ ক্ষেত্রে রোগ নির্ণয় একটা ভাল ইতিহাস গ্রহণের মাধ্যমে অর্জন করা সম্ভব।